হলুদ ফ্রক
আজ ঈদ। ঝিলমের আজ ভীষণ মন খারাপ। বারান্দার গ্রিলটা ধরে ঝিলম দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বাসার সামনের বিশাল মাঠটা বৃষ্টির পানিতে থই থই। পাশেই পচা ডোবা, ডোবা ভরা বেগুনি রঙের কচুরিপানার ফুল। কচুরিপানার ফুল ঝিলমের ভীষণ প্রিয়। ঝিলমের খুব কান্না পাচ্ছে। আজ ঈদ অথচ ঝিলমের নতুন কোনো জামা নেই। সব ছেলেমেয়ে ঈদের নতুন জামা পরে ঘুরতে বেরিয়েছে। আর সে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে। মায়ের ওপর ভীষণ অভিমান হচ্ছে। মা কি তাকে একটুও বোঝে না? একটাই তো নতুন জামা চেয়েছিল, তাও মা তাকে দিতে পারল না? তার সব বান্ধবী যে পাঁচ-ছয়টা করে জামা পেয়েছে অথচ তার একটাও নেই। কীভাবে সে বাইরে যাবে? কীভাবে বান্ধবীদের বলবে তার একটা জামাও নেই? সবাইকে যে সে বলে রেখেছে মা তাকে পাঁচটা নতুন জামা কিনে দিয়েছে। গতকাল মায়ের একটা নতুন শাড়ি কেটে মা তার জন্য একটা ফ্রক বানিয়েছে। তাও সেলাইয়ের টাকা বাঁচানোর জন্য তার খালামণিকে দিয়ে সেলাই করিয়েছে। খালামণিকে তার একটুও পছন্দ না। এত পচা একটা ফ্রক বানিয়েছে। আবার বলে, ‘এই ঝিলম, দেখ দেখ কী সুন্দর ফ্রক বানিয়েছি। দেখি আয় তো একটু গায়ে দিয়ে দেখা।’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখটা গোমড়া করে তাকে ফ্রকটা পরতে হয়েছে। ইশ্ হাতাটা কী ঢোলা, এত ঢোলা কি কেউ পরে? এটা সে কোনো দিনও পরবে না...। তার চোখ ভরে পানি চলে আসে আর খালামণি বলে, ‘ওমা তোকে তো খুব মানিয়েছে।’ ছাই মানিয়েছে, কচু মানিয়েছে, ঝিলম মনে মনে বলে। জামাটা খুলে সে মায়ের বিছানার ওপর ফেলে দৌড় দিয়ে বারান্দায় আসে। তার খুব চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে...‘ঝিলম, এই ঝিলম’...মায়ের গলা ভেসে আসে। ‘এদিকে আয় তোর বান্ধবীরা এসেছে। কী রে এখানে দাঁড়িয়ে কেন? পৃথা আর তন্বী এসেছে। চল রেডি হয়ে ওদের সঙ্গে একটু বাইরে বেরিয়ে আয়।’ ঝিলম মায়ের দিকে তাকায়, কী অদ্ভুত মায়ায় ভরা মুখ মায়ের। সে তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে না যে, মা, আমি ওই জামা পরব না।
‘কী রে তাকিয়ে আছিস কেন? চল...তোর দুলাভাইয়ের দেওয়া জামাটা পর, ওটা তো এক দিনও পরিসনি।’ ঝিলমের আবার কান্না পায়। এক বছর আগে দুলাভাই তাকে একটা ফ্রক দিয়েছিল, ওটাও তার পছন্দ না, কেমন বিচ্ছিরি হলুদ রঙের। মা হাত ধরে ঝিলমকে নিয়ে আসে। জামা পরিয়ে চুল বেঁধে ২০ টাকা ঈদি দেয়। পৃথা আর তন্বীর সঙ্গে ঝিলম বেরিয়ে আসে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে মা ঠিক তার মতো বারান্দায় গ্রিলটা ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এত দূর থেকেও ঝিলম বোঝে মায়ের চোখে পানি। মা মিষ্টি হেসে হাত নেড়ে তাকে বিদায় জানায়।
ঝিলম মুখটা ফিরিয়ে নেয়। তার চোখ ভরে পানি আসে। জামা নিয়ে তার আর কোনো কষ্ট নেই। সে জানে মা এখন ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদবে, যেমনটা সে প্রতি রাতে কাঁদে। তার বাবা বিদেশ থাকে, আজ ছয় মাস বাবার কোনো খোঁজ নেই। মায়ের অনেক কষ্ট। ঝিলম মনে মনে বলে, মা, তুমি কেঁদো না। সব ঠিক হয়ে যাবে মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ঝিলমের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
মারিয়া সুলতানা
এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment